Mayavati -- Swamijir Swapna-sambhaba

মায়াবতী আশ্রম, মার্চ - ২০১৭

মায়াবতী – স্বামীজীর স্বপ্নসম্ভবা I
মানসী বন্দ্যোপাধ্যায় (চক্রবর্তী)
English Translation follows soon.




দেবতাত্মা নগাধিরাজ হিমালয়ের চম্পাবত ও ধরমগড় গিরিশ্রেণী তিনদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে মায়াবতীকে I মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রম, স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের জীবন্ত রূপ; রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বৌদ্ধিক (Intellectual) ধারার প্রধান উপনদী I

 উপনিষদের  ঋষির  মন্ত্রে যে অদ্বৈতবাদ ধ্বনিত হয়েছিল, স্বামীজীর ধ্যানে, মননে, চেতনায়, কর্মে সেই অদ্বৈতের-ই অগ্নি দীপ্ত শিখায় জ্বলে ।
আছ, আছ, তুমি আছ,
ধাবমান জীবনে তুমি আত্মার আত্মা
ওঁ তৎ সৎ ওঁ আমার ঈশ্বর তুমি,
প্রিয় আমার, আমি তোমারি, আমি তোমারি ।
(তৎ সৎ - That only Real Existence – স্বামীজীর টীকা )-- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খন্ড



১৮৯৮ সালের জুন মাসে স্বামীজী তাঁর কিছু গুরুভাই এবং দেশী ও বিদেশী শিষ্য শিষ্যা সহ আলমোড়ায় অবস্থান করছিলেন I সেই সময়ে  তাঁর কাছে প্রবুদ্ধ ভারত-এর সম্পাদক শ্রী বি.আর. রাজ আয়ারের  মে মাসে মাদ্রাজে নেফ্রাইটিস রোগে আকস্মিক অকালপ্রয়াণের দুঃসংবাদ এল I বিষণ্ণ স্বামীজী স্থির করলেন প্রবুদ্ধ ভার প্রকাশনা বন্ধ হবে না, স্বামী স্বরূপানন্দকে প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে  পত্রিকাটি প্রকাশনার কাজ তিনি অব্যাহত রাখবেন I



সরযু নদী , মায়াবতী  যাত্রাপথে

 মাদাম ও ক্যাপটেন  সেভিয়ার  অদ্বৈতবেদান্ত  দর্শনে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। লন্ডনে মাদাম সেভিয়ারকে প্রথম সাক্ষাতের দিনই স্বামী বিবেকানন্দ  মাতৃসম্বোধন করেছিলেন I তিনি বলেছিলেন,”Would you not like to come to India ? I will give you off my best realization’’ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শার্লট সেভিয়ার এই কথাটি ভুলতে পারেন নি।   তাঁরা দুজন স্বামীজীকে  শুধু গুরু নন, সন্তানবৎ মনে করতেন।  (Mother of Mayavati: The Story of Charlotte Sevier and Advaita Ashrama By Amrita M. Salm)
   
ক্যাপটেন  সেভিয়ারকে স্বামীজী বললেন,
  “সেভিয়ার, আপনি বলেছেন আপনি ভারতের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন I বাংলার আবহাওয়া আপনার সহ্য হবে না,  আপনি আলমোড়ার কাছাকাছি কোন জায়গায় থেকে প্রবুদ্ধ ভারত প্রকাশনার ব্যবস্থা করুন I এই পত্রিকা আমার উপদেশে শুরু হয়েছিল, আজ এর গ্রাহক সংখ্যা তিনহাজার, বৈদান্তিক দর্শন প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে  এই পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে I আমি চাই না যে সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে যাক I

   “আমি আপনাকে একজন সুযোগ্য সম্পাদক দেব I স্বামী স্বরূপানন্দের এই বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতা আছে, আপনার ও তুরীয়ানন্দের সাহায্যে তিনি সহজেই পত্রিকা প্রকাশ করতে পারবেন I
 (স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন, খন্ড -২, পৃ-১১১ , উদ্ধৃত- The Charm of Mayavati Ashrama পৃ-৪৭)


প্রবুদ্ধ ভারত কার্য্যালয় মাদ্রাজ থেকে আলমোড়ায় এক ভাড়াবাড়ি থমসন হাউস (Thompson House)-এ স্থানান্তরিত হল I একটা হ্যান্ড প্রেস ও প্রিন্টিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কোলকাতা থেকে আলমোড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো I ১৮৯৮ সালের অগাস্ট মাসে প্রবুদ্ধ ভারত-এর সংখ্যা এখান থেকে বের হল I

ইতিমধ্যে শান্ত, নিভৃত পার্বত্য এলাকায় একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল যে আশ্রমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানী ব্যক্তিরা মিলিত ভাবে অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন ও ধর্ম আলোচনা এবং প্রচার করতে পারবেন আর প্রবুদ্ধ ভারত-এর স্থায়ী, নিজস্ব এক ঠিকানাও রচিত হবে I রোমাঁ রোলাঁ বলেন , স্বামীজী সম্বন্ধে অপত্যস্নেহ থাকার কারণে ক্যাপটেন সেভিয়ার অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠায় বিশেষ মনোযোগী হলেন ।তিনি  আলমোড়া অপেক্ষা নিভৃত, গহীন কোন অন্য স্থানের সন্ধান শুরু করলেন I অবশেষে ক্যাপটেন সেভিয়ার ও  স্বামী স্বরূপানন্দ ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের পর জেনারেল ম্যাকগ্রেগরের মালিকানাধীন মায়াবতীর স্থানটি পছন্দ করলেন , তখন এটি আলমোড়া জেলার মধ্যে ছিল I ৬০০০- ৭০০০ ফুট উচ্চতাপার্বত্য ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে এই স্থান , হিমালয়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গ – নন্দাদেবী, কামেট, চৌখাম্বা, ত্রিশূল, কেদারনাথ, বদ্রীনারায়ণ দৃষ্টিগোচর হয় I  ভবিষ্যৎ আশ্রম ৬৪০০ ফুট উচ্চতায় স্থাপিত হতে পারবে I ১৮৯৯ সালের ২রা মার্চ তিনটি ছোট বাড়ি ও চা বাগান সহ স্থানটি কেনা হল; ১৯শে মার্চ রবিবার শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জন্মদিনে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হI




স্বামীজীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল হিমালয়ের কোলে এমন এক আশ্রম হবে যেখানে কোনোরকম  আনুষ্ঠানিক পুজোপদ্ধতি অনুসৃত  হবে না, যেখানে নৈঃশব্দ, শান্তি, বিশালত্ব, ব্যাপ্তি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, মানবমনকে স্বতঃই  অন্তর্নিবিষ্ট করবে মায়াবতীতে তাঁর সেই সযত্নলালিত স্বপ্ন সফল হল I ত্যাগভুমি হিমালয়, যোগভুমি হিমালয় তাঁর স্বপ্নচিন্তায় অনিবার ছায়া ফেলছিল !  “ তাঁহার নিকট হিমালয়ের বাতাস পর্যন্ত সেই অনাদি অনন্ত ধ্যানের বিষয়ীভূত মূর্তি দ্বারা ওতপ্রোত, যে-ধ্যান সুখচিন্তার দ্বারা ভগ্ন হইবার নহে I”( ভগিনী নিবেদিতা)




 ক্রিস্টাইন গ্রীনস্টাইডেলকে ৫ই আগস্ট ১৮৯৬ তিনি লিখেছিলেন, “ আমি এখন সুইৎজারল্যান্ডে অবিরাম পরিভ্রমণের পর অতিপ্রয়োজনীয় বিশ্রামে রয়েছি - এ যেন হিমালয়েরই এক ছোট্ট সংস্করণ, (হিমালয়ের মতোই) এই স্থানও সমস্ত জাগতিক অনুভূতি ও বন্ধন বিতাড়িত করে মনকে আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে I আমি পরিপূর্ণ রূপে একে উপভোগ করছি I”

আলমোড়া


আলমোড়া নিবাসী লালা বদ্রী শা-কে প্রেরিত চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তিনি আলমোড়া বা তার নিকটবর্তী অঞ্চলে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক, সেজন্য মিঃ রামসে-র বাগান সহ বাড়ী বা অন্য কোন বাড়ি কেনা অথবা ভাড়ায় পাওয়া সম্ভব কিনা, খোঁজ নিয়ে দেখা হোক I কাশ্মীরে স্বামীজী সেভিয়ার দম্পতিকে উপযুক্ত স্থান সন্ধানের দায়িত্ব দিলেন কারণ তিনি নিজে যে কয়েকটি স্থানের সন্ধান পেয়েছিলেন, কোনটিই তাঁর আশ্রম স্থাপনের উপযুক্ত মনে হয় নি  I

১৭ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৬, জার্মানী ও হল্যান্ড  ঘুরে স্বামীজী  লন্ডন ফিরলেন I ২০ নভেম্বর ১৮৯৬ সালের শেষ দিকে তিনি আলাসিঙ্গা পেরুমল, লালা বদ্রী শা, হেল ভগ্নিদ্বয়কে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা লিখলেন ।

ভগিনী নিবেদিতা ‘স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে’তে লিখছেন :  “এই সময়ে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ মাদ্রাজ হইতে মায়াবতীতে নবপ্রতিষ্ঠিত আশ্রমে স্থানান্তরিত হওয়ায় আমরা সকলে প্রায়ই ইহার কথা ভাবিতাম ।



  “স্বামীজী এই পত্রিকাখানিকে বিশেষ ভালবাসিতেন। তৎপ্রদত্ত সুন্দর নামটিও তাহার পরিচয়। তাঁহার নিজের কয়েকখানি মুখপত্র থাকে, এজন্য তিনি সদাই উৎসুক ছিলেন। বর্তমান ভারতে শিক্ষাবিস্তার-কল্পে মাসিক পত্রের কি মূল্য, তাহা তিনি সম্যক রূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, এবং অনুভব করিয়াছিলেন যে, বক্তৃতা এবং লোকহিতকর কার্যের ন্যায় এই উপায় দ্বারাও তাঁহার গুরুদেবের উপদেশাবলী প্রচার করা আবশ্যক। সুতরাং দিনের পর দিন তিনি যেমন বিভিন্ন কেন্দ্রের লোকহিতকর কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতেন, তাঁহার কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ঠিক সেইরূপ করিতেন। প্রতিদিন তিনি স্বামী স্বরূপানন্দের নব সম্পাদকত্বে আশু-প্রকাশোন্মুখ প্রথম সংখ্যাখানির বিষয়ে কথা পাড়িতেন।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, নবম খন্ড)

মায়াবতী আশ্রমের নিচে ( মার্চ, ২০১৭ )
মায়াবতী আশ্রমের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট স্বামী বিরজানন্দ লিখেছেন, ১৮৯৯ সালে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর লেখা পত্রে মায়াবতী আশ্রমের প্রসপেক্টাস নির্ধারন করে দিয়েছিলেন ।  এই অনুসারে আশ্রমের কর্মপদ্ধতি হবে মূলতঃ তিন ধরনের :

১) ট্রেনিং, প্রচারণ, সাহিত্যিক কর্ম বা literary work ; ২)শিক্ষাকার্য্য বা educational work ;
৩)সেবাদান বা charitable work I এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতাদান, শিক্ষক হিসেবে সদস্যদের তৈরী করা আশ্রমের এক বিশেষ কাজ হবে I

অদ্বৈত আশ্রমের prospectus বলে :
… Here it is hoped to keep Advaita free from all superstitions and contaminations. Here will be tought and practiced nothing but the Doctrine of Unity, pure and simple ; and though in entire sympathy with all other systems, this ashrama is dedicated to Advaita and Advaita alone…



 আশ্রমের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য স্থির হল আশ্রমিকরা ঘরে ও বাইরে  অদ্বৈতর স্মরণ , মনন ও প্রচারণ করবে ; দ্বিতীয়ত- সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীদের  অন্তর্ভুক্তিকরন এবং শিক্ষাপ্রদান করা হবে  যাতে তারা সারা বিশ্বে অদ্বৈতবাদ প্রচার করতে পারে। জাত, বর্ণ, শ্রেণী,  গোত্র নির্বিশেষে মানুষ আশ্রমে ভর্তি হতে পারত । যারা সমস্ত রকম পার্থিব বিষয় পরিত্যাগ করে আত্মোন্নতি ও আশ্রমের কাজে নিজেকে পরিপূ্র্ণ ভাবে উৎসর্গ করতে চাইত , আশ্রমের সংবিধান অনুসারে তারা ইনমেট হিসেবে গৃহীত হত । আশ্রমের কমিটি অফ ট্রাস্টি এঁদের একটি নি্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রেনিং দিতেন, ট্রেনিং শেষে এঁরা আশ্রমের সদস্য হিসেবে গণ্য হতেন ।




নমেট ও সদস্য উভয়ের ক্ষেত্রেই আশ্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপৃর্ণ সাধারন নিয়ম বা general rule ছিল : ১। কোনরকম ছবি বা মুর্তিপুজো করা যাবে না, আশ্রম কর্তৃক অনুষ্ঠিত বিরজা হোম ছাড়া অ্ন্য  কোনরকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা যাবে না I ২।  তপম ও অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনা করতে হবে, পড়াশুনো করতে হবে, আশ্রমের কোন না কোন বিভাগে কাজ করতে হবে। ৩।অদ্বৈতে বিশ্বাস রেখে, অদ্বৈত প্রচারের সঙ্গে সদস্যরা অ্ন্য সমস্ত ধর্মীয় দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে।

বর্তমান মায়াবতীর  পুষ্পশোভিত উদ্যান

মায়াবতীতে স্বামীজী যে মহান, অত্যুচ্চ ভাবধারা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন তার প্রতিফলন হল ৮ই এপ্রিল ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে সান ফ্রান্সিসকোতে Is Vedanta Future Religion? ভাষণে I স্বামীজী বললেন,  “হিমালয়ের উপরে আমার একটি স্থান আছে যেখানে বিশুদ্ধ সত্য ব্যতীত আর কিছুরই প্রবেশাধিকার থাকিবে না-এরূপ মনঃস্থ করিয়াছি।একটি ইংরেজ-দম্পতি ঐ স্থানের দায়িত্বে রহিয়াছেন।উদ্দেশ্য – সত্যানুসন্ধিৎসুদের শিক্ষিত করা এবং বালকবালিকাদিগকে ভয়হীন ও কুসংস্কারহীন ভাবে গড়িয়া তোলা। তাহারা যীশু,বুদ্ধ,শিব,বিষ্ণু-ইত্যাদি কাহারও বিষয় শুনিবে না।তাহারা প্রথম হইতেই নিজের পায়ে দাঁড়াইতে শিখিবে। তাহারা বাল্যকাল হইতেই শিখিবে যে ঈশ্বরই চেতনা এবং তাঁহার পূজা সত্য ও জ্ঞানের মধ্য দিয়া করিতে হয়।সকলকেই চেতন রূপে দেখিতে হয় – ইহাই আদর্শ।”  (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খন্ড)



এই আদর্শ প্রচারে স্বামী স্বরূপানন্দ স্বয়ং কুমায়ুন ও গাড়ওয়াল ; রাজপুতানার বিস্তৃত অঞ্চল এবং অন্যত্র পরিভ্রমণ করেন।তাঁর জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নৈনিতালে তাঁর দেহান্ত হয় ।

১৮৯৯ সালের বসন্তে সেভিয়ার দম্পতি চেয়েছিলেন স্বামীজী আশ্রমে এসে আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করুন । ভগিনী নিবেদিতার লেখা থেকে জানা যায় ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে স্বামীজী লখনৌ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন, পাহাড়ে উঠতে পারলেন না । ভগিনী নিবেদিতা সেভিয়ারকে বলেন, লখনৌতে নেমে স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে- নিউরোলজিয়া রোগে আক্রান্ত  সেভিয়ার নামতে পারেন নি I ২৮শে অক্টোবর ১৯০০ সালে স্বামীজীর পাশ্চাত্য ভ্রমণকালে সেভিয়ারের মৃত্যু হয় I স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর মাদাম সেভিয়ারকে সান্ত্বনা দিতে স্বামীজী মায়াবতী আশ্রমে এসে কিছুদিন বাস করেন ।



প্রথমদিকের মায়াবতী আশ্রম সম্বন্ধে অনুপুঙ্খ বিবরণ পাই সরলা দেবী চৌধুরানীর লেখায় :

 আমি গিয়েছিলুম তখন হিমালয়ের উপর স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত  মায়াবতী আশ্রমে I সেখানে দেখলুম সেই অম্বর চুম্বিত ভাল হিমাচলভারতবর্ষকে আমার, “সেই শুভ্র তুষার কিরীটিনী মাকে আমার । আহা কি সুন্দরী!চোখের সামনে ঝকঝক ঝকমক করছে কেদার ও বদ্রীনারায়নের শৃঙ্গ !...

আমি এখানে বিবেকানন্দে গুরুভ্রাতা তুরীয়ানন্দের নিকট প্রতিদিন উপনিষদ অধ্যয়নে ব্যাপৃত হলুম । ভগবদ্ গীতার সঙ্গে পরিচয়সাধনও এখানে আরম্ভ হল।
চৈনিক গোলাপ মায়াবতীর বাগানে


“আশ্রম যে শুধু একটি আধ্যাত্মিক ভূমি নয়,তার ভৌতিক স্তরও যে একটি আছে- কারণ যেখানেই মানুষের নিবাস সেখানেই তার দেহধারণের উপকরণাদির সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রয়োন এবং সে জন্যে বিধিব্যবস্থার একান্ত আবশ্যক-সেদিকটা ইতিপূর্বে আমার মনে কখনো উদ্ভাসিত হয় নি। .. এখানে দেখলুম আশ্রমাধ্যক্ষ স্বামী স্বরূপানন্দ -যাঁর সঙ্গে বেলুড়ে প্রথম সাক্ষাৎ হয় - প্রবুদ্ধ ভারত নামীয় অতি উচ্চাঙ্গের একখানি ইংরেজী পত্রিকা সম্পাদন করছেন, ব্রহ্মচারীদের জন্য বেদান্ত ক্লাসে নিয়মিত অধ্যাপকতা করছেন, আবার তিনিই অন্য সময় অতিথি-অভ্যাগতদের সৎকারের ত্রুটি না হয় বলে ভান্ডারগৃহ থেকে চাল,ডাল,আটা,কিসমিস,পেস্তা,বাদাম প্রভৃতি বের করে রৌদ্রে শুখতে দিচ্ছেন, নিজের হাতে পোকা বেছে ঝেড়ে ঝুড়ে আবার ভাঁড়ারে তুলছেন।কোন কর্মই তাঁদের পক্ষে অবহেয় নয়।ধীরে ধীরে আমার মনে অনুপ্রবেশ করলে যে এই হল জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের সমন্বয় ; এঁদের এই গৃহস্থতুল্য কর্মের ভিতর গৃহস্থের স্বার্থপরবশতা নেই,শুধু কর্তব্যের ও পরসেবার অনুপ্রেরণা রয়েছে।

      “আশ্রমবাসী প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন নিয়তকর্ম । শীতকালে এঁদের পথঘাট বরফে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, - এক অংশ থেকে আরেক অংশে গতিবিধি দিনের পর দিন বন্ধ থাকে। শীতাগমের পূর্বেই তাই নিজেদের গাছ থেকে কাঠ কেটে স্তূপীকৃত করে রাখার একান্ত দরকার ।এই আশ্রম এমন জায়গায় সন্নিবিষ্ট যার তিন মাইলের মধ্যে কোন লোকালয় নেই,পোস্টাপিসও নেই,আবার এরই ভিতর দিয়ে পাক-দন্ডী করে সাধু-সন্ন্যাসীরা ক্রমাগত বদরি-কেদারাভিমুখে যাত্রা করেনতাঁদের  শীত-গ্রীষ্ম ঋতুভেদ নেই।আমাদের মত সৌখীন আগন্তুকেরা যদিও বেছে বেছে ভাল সময়েই আসেন তবুও তাঁদের আতিথ্যের জন্যেও সর্বপ্রকার উপকরণ সকল সময় প্রস্তুত রাখার দরকার হয় ।..

যাঁরা সক্ষম, তাঁদের এখানে অবস্থান ও পান-ভোজনের জন্য একটা মাসিক হার নির্ধারিত আছে।মাদাম সেভিয়ার যিনি এই বিভাগের অধিষ্ঠাত্রী তাঁর কাছে শুনলুম এ বিষয়ে তাঁদের কঠোর নিয়ম অবলম্বন করতে হয়েছে কারণ ইতিপূর্বে .. অনেক আগন্তুকেরা .. সম্পূর্ণ সক্ষম হলেও মাসের পর মাসফ্রি হোটেল ও স্যানেটোরিাম স্বরূপ এটাকে ব্যবহার করেছেন ।.. সাধু-সন্ন্যাসীরাই আশ্রমের যথার্ত অতিথি যাঁরা ন তিথি দ্বিতীয়াঅতিবাহিত করেন।



দুটি পাহাড়ের উপর দুটি বাংলো, উপরটিতে সাধুদের নিবাস, নীচে থাকেন কর্নেল ও মিসেস সেভিয়ার I  কর্নেল সেভিয়ার সম্প্রতি দেহরক্ষা করেছেন, সকলের মাতৃস্বরূপিণী বৃদ্ধা মিসেস সেভিয়ার এখন একাকীই আছেন ।তাঁরই টাকায় এ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত ও এর খরচ নির্বাহ হয়।
একজন আমেরিকান সাধু ও একজন আমেরিকান ব্রহ্মচারী উপরের আশ্রমে সন্ন্যাসীদের  সঙ্গেই থাকেন। সাধুটি কেবল আধ্যাত্মিক পথের পথিক। ব্রহ্মচারীটির রাজসিক প্রকৃতি তাঁকে কর্মবহুলতার সিঁড়ি দিয়েই আধ্যাত্মস্তরে ক্রমে ক্রমে উন্নীত করছে । আমি থাকতে একজন আমেরিকান শিষ্যা এলেন সন্ন্যাস বেশধারিণী ।
এখনো কোনো কোনো গভীর রাত্তিরে  পাহাড়শীর্ষের  জঙ্গল থেকে নেকড়ে বাঘের ডাকশোনা যায়।


“…সেই সময় একটি মারাট্টী যুবক সেখানে এসেছিল, সে হঠযোগপন্থী।.. ও আমার সঙ্গে কোন কোন সাধুরা রোজ সায়াহ্নে ভ্রমণে বেরতেন।কোন একটা বসবার মত স্থানে পৌঁছলে সবাই মিলে সেখানে বসতাম ও সাধুরা গান করতেন।

এই স্মূতিচারণ এবং মায়াবতী ডায়েরী মায়াবতী রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত আশ্রমের যাবতীয় কার্যাবলীর বিবরণ যুগপৎ শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম উদ্রেক করে I

আজকের রডোড্রেনডন ফুলে ভরা উপত্যকায়, পাইনের মর্মরে কম্পিত বাতাসে, আতপ্ত চৈত্রবিকেলে মৌমাছির পাখার গুঞ্জরণে , নাম না জানা কতো পাখির গুঞ্জরণে সেই কতদিন আগের ফেলে আসা দিনরাজি কাঁপে I 
                         ________  




 গ্রন্থসূচী –

  স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,                        
  The Charm of Mayavati ashrama – Compiled & Edited by Swami Satyapriyananda
Complete works of Sister Nivedita, Vol- I
জীবনের ঝরাপাতা - সরলা দেবী চৌধুরাণী
Mother of Mayavati: The Story of Charlotte Sevier and Advaita Ashrama - Amrita M. Salm

                                ________   

Comments